সূর্যোদয়ে তুমি সূর্যাস্তেও তুমি ও আমার বাংলাদেশ, প্রিয় জন্মভূমি- আমার খুব প্রিয় গান। আমার দীর্ঘ ২৪ বছরের প্রবাস জীবনে দেশাত্মবোধক গানের মধ্যে এই গানটি আমি কত শতবার শুনেছি জানি না। এ গানটির মাঝে আমি দেখতে পাই বাংলার অপরূপ মুখ। গানটির গীতিকার : মনিরুজ্জামান মনির। সুরকার : আলাউদ্দিন আলী। গানটি গেয়েছেন আমাদের বাংলা গানের অন্যতম প্রবাদ পুরুষ, জীবন্ত কিংবদন্তী শিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী।তার গাওয়া কালজয়ী অনেক দেশের গানই শ্রোতাদের দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করে। বাংলা গানের শুরু থেকে আমাদের দেশে বা আমাদের ভাষায় যত দেশাত্মবোধক বা দেশপ্রেমমূলক গান আছে আমার মনে হয় না পৃথিবীর আর কোনো দেশে বা আর কোনো ভাষায় দেশপ্রেমের এত গান আছে। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে গান গাইছেন সৈয়দ আবদুল হাদী। তার জন্ম বৃহত্তর কুমিল্লা জেলায়। বেড়ে উঠেছেন আগরতলা, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া এবং কলকাতায়। তবে তার কলেজ জীবন কেটেছে রংপুর আর ঢাকায়। বাবা সৈয়দ আবদুল হাই। তার বাবা গান গাইতেন আর কলের গানে গান শুনতে পছন্দ করতেন। বাবার শখের গ্রামোফোন রেকর্ডের গান শুনে সেই কৈশোর জীবন থেকেই সঙ্গীত অনুরাগী হয়ে উঠেন সৈয়দ আবদুল হাদী। ছোটবেলা থেকে গাইতে গাইতে গান শিখেছেন। তারপর আর থেমে থাকেননি। নিরন্তর গান করে খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
সৈয়দ আব্দুল হাদীর গাওয়া দূরদেশ ছবির একটি গান আজও শুনতে ভীষণ ভালো লাগে। যেও না সাথী, ও যেও না সাথী, চলেছো একেলা কোথায়-- গানটি লিখেছেন আহমদ জামান চৌধুরী। সঙ্গীত পরিচালনা করেন বোম্বের ঊষা খান্না। এই গানটি সাবিনা ইয়াসমিনও গেয়েছেন এবং হিন্দিতে গেয়েছেন লতা মুঙ্গেশকর। ফকির মজনু শাহ ছবিতে গেয়েছিলেন ‘চক্ষের নজর এমনি কইরা একদিন খইয়া যাবে’ সৈয়দ আব্দুল হাদী অনেক দরদ দিয়ে গেয়েছেন গানটি। গানের কথা গুলো অসাধারণ। গীতিকার : গাজী মাযহারুল আনোয়ার। সুরকার : আলাউদ্দিন আলী। ‘একবার যদি কেউ ভালোবাসতো’ গীতিকার: আমজাদ হোসেন। সুরকার: আলাউদ্দিন আলী। ছবির নাম : জন্ম থেকে জ্বলছি। ‘চলে যায় যদি কেউ বাঁধন ছিঁড়ে কাঁদিস কেন মন’ এটি লিখেছেন মাসুদ করিম। এর সুরকার সুবল দাস। ‘ভাঙাগড়া’ চলচ্চিত্রের খুব জনপ্রিয় গান। আবদুল হাদীর আরেকটি খুব জনপ্রিয় গান ‘জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো আর কতদিন বল সইবো’ গানটি লিখেছেন আমজাদ হোসেন, সুর করেছেন আলাউদ্দিন আলী। ছবির নাম : জন্ম থেকে জ্বলছি। একটি সামাজিক গল্প নিয়ে নির্মিত এ ছবিটি দেখে কাঁদেননি এমন মানুষ কম। সৈয়দ আব্দুল হাদী ১৯৭৮ সালের সেরা চলচ্চিত্র গোলাপী এখন ট্রেনে চলচ্চিত্রে সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে তিনি অসাধারণ কয়েকটি গান উপহার দিয়েছেন। গোলাপী এখন ট্রেনে ছবিতে ‘আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার’ গানটি প্রচুর জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এমন আরো অসংখ্য জনপ্রিয় গানের কণ্ঠবাহক সৈয়দ আবদুল হাদী। যুগযুগ ধরে এসব গান সময়ের ধারাবাহিকতায় প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে ভালোলাগার জন্ম দিয়েছে বলেই আজো সৈয়দ আবদুল হাদীর গান শুনে শ্রোতারা মুগ্ধ হন। পুরনো দিনের গানগুলোর আবেদন সব সময় থাকবে।
চলচ্চিত্রের কণ্ঠশিল্পী হিসেবেই সৈয়দ আবদুল হাদীকে সবাই চেনেন-জানেন। তিনি রবীন্দ্রসংগীত গেয়েও শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন। সম্প্রতি তারই কণ্ঠে এক ভিন্নস্বাদের আবেশ পেল শ্রোতারা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কিছুদিন আগে বাজারে আসে সৈয়দ আবদুল হাদীর প্রথম রবীন্দ্র সংগীতের একক অ্যালবাম ‘যখন ভাঙলো মিলন মেলা’ অ্যালবামটি বাজারে আনে অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান লেজার ভিশন। অ্যালবামটিতে মোট নয়টি গান স্থান পেয়েছে। নয়টি গান অ্যালবামে সৈয়দ আবদুল হাদী নিজের পছন্দানুযায়ী করেননি। বাবা সৈয়দ আবদুল হাই শখের বসে গান করতেন। ছোটবেলায় সেই গানগুলো বেশ মন দিয়ে শুনতেন ছেলে সৈয়দ আবদুল হাদী। রবীন্দ্রসংগীতই বেশি গাইতেন তাঁর বাবা। যেসব গান তার বাবার কণ্ঠে বেশি বেশি শুনতেন ঠিক তেমন সাতটি গান অ্যালবামের জন্য গেয়েছেন তিনি। নিজের পছন্দের দুটি গান শুধু গেয়েছেন। সে দুটি গান হচ্ছে ‘তুমি কি কেবলই ছবি’ এবং ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন।’ উল্লেখ্য, চলচ্চিত্র ও আধুনিক গানের অন্যতম এ শিল্পী ইতিপূর্বে নজরুল সংগীতেরও অ্যালবাম বের করেছিলেন। তার ছোট মেয়ে তনিমা হাদীরও একটি অ্যালবাম প্রকাশের ইচ্ছা রয়েছে। মেয়ে তনিমা হাদীও বাবার মত গান করেন। তনিমা হাদী স্বামী রাকিবের সঙ্গে থাকেন সুইজারল্যান্ডে। সৈয়দ আবদুল হাদী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা নিয়ে অনার্স পড়ার সময় সুবল দাস, পি.সি গোমেজ, আবদুল আহাদ, আবদুল লতিফ প্রমুখ তাকে গান শেখার ক্ষেত্রে সহায়তা ও উৎসাহ যুগিয়েছেন। তার বাবা ছিলেন ইপিসিএস (ইস্ট পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস) অফিসার। তার বাবা চেয়েছিলেন সৈয়দ আবদুল হাদী যেন সি.এস.পি হন।
সৈয়দ আবদুল হাদী জগন্নাথ কলেজে তিন বছর পড়িয়েছেন। বিটিভির প্রথম চারজন প্রডিউসারের একজন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় মাস্টার্স শেষ করে লন্ডনে ওয়েল্স ইউনিভার্সিটিতে প্রিন্সিপাল লাইব্রেরিয়ান হিসেবে অবসর নিয়েছেন সৈয়দ আবদুল হাদী। তার স্ত্রীর মৃত্যুর পর মানসিকভাবে খুব কষ্ট পেয়েছেন। স্ত্রীর চলে যাওয়াটা তার কাছে অনেক কষ্টের। তার ভালো-মন্দ দেখাশোনা করতেন তার স্ত্রী যার উপর তিনি সম্পূর্ণ নির্ভর করতে পারতেন। সৈয়দ আবদুল হাদী ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশে গান করতে গিয়েছেন। ১৯৭৮ সালে চীনে একটি অনুষ্ঠানে বাংলা গান শুনিয়ে ঐ দেশের শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছিলেন যদিও তারা বাংলা বোঝেন না। লন্ডনের ওয়েল্স ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক নাইট অনুষ্ঠানে বাংলা, উর্দু ও হিন্দী গান করেছিলেন। বাংলাদেশের শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে গেয়ে তাদেরকে মুগ্ধ করেছিলেন। সৈয়দ আবদুল হাদী ১৯৮১ সালে ভারতের ছয় সাতটি স্থানে গান করেছেন। পরপর পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান জীবন্ত কিংবদন্তী শিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী। এর মধ্যে রয়েছে - গোলাপী এখন ট্রেনে - ১৯৭৮, সুন্দরী - ১৯৭৯, কসাই - ১৯৮০, গরীবের বউ - ১৯৯০ এবং ক্ষমা ১৯৯২।লেখক: রওশন আরা বিউটি, দৈনিক আজাদি থেকে সংগৃহীত
No comments:
Post a Comment